বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

বাঘায় পদ্মার বাঁধে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন রক্ষার চেষ্টা

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি::

বাতাসে পানির ঢেউ এসে পাড়ে আঘাত করায় মাটি ধসে পড়ছে। পদ্মার প্রবল স্রোত আর আছড়ে পড়া ঢেউ দেখিয়ে শুকচাঁন আলী বলছিলেন, ‘দেখেন ক্যামন করে ঢেউ ভাঙছে। হাত বাড়িয়ে মধ্য পদ্মার দিকে ইশারা করে ষাটোর্ধ্ব শুকচাঁন আলী বলেন, ঠিক ওই জায়গায় তার বসতি ছিল।

হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘গত তিনবছর আগে জমিজমার সঙ্গে বাড়িঘর পদ্মায় খাইছে। নদীর তীরঘেঁষা ছেতাব আলীসহ বেশ কয়েকজন বলেন, ঘর থেকে রাত জেগে ভাঙনের সেই আওয়াজ কান পেতে শুনতে হয়, কখন ঘরবাড়ি গ্রাস করবে পদ্মা, সেই আতঙ্কে। ঘর-বাড়ি হারানোর আতঙ্কে তাদের মতো একই আফসোস পদ্মাপাড়ের মানুষদের। কেননা নদীর তীরজুড়ে দেখা দিয়েছে প্রবল ভাঙন। কয়েকদিন ধরে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাপক ভাঙন দেয়, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আলাইপুর নাপিতপাড়া, মধ্যপাড়া ও দক্ষিনপাড়া এলাকায়। এই ভাঙনে নদীর পেটে চলে গেছে শুকচাঁন, লালু, মুনছার, ছেতাব, টেনু, মহরম, রবিউল, অলতাফ, কমল, বাদশা, মিলন, আকরাম, আলম, সাধু, মনি, সেলিম, লাভআলী, আখের ও বিকুলসহ অনেকের কয়েকশ’ বিঘা জমিসহ গাছপালা। ঘরবাড়ি হারানোর আতঙ্কে অধিক ঝুঁকির মুখে বসবাস করছে নদীতীরবর্তী শতাধিক পরিবার।

ভাঙন থেকে রক্ষায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ধসে যাওয়া স্থান মেরামত ও ভাঙন প্রতিরোধে এ কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে স্থানীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে। তার আগে গোকুলপুর-জোতকাদিরপুর বাঁধের কাছে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়। তবে ভাঙনের আগে পাউবোর বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু ছিল তা নিয়ে স্থানীয়দের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। জরুরি ভিত্তিতে পদ্মার ১ কিলোমিটার ভাঙন রক্ষায় প্রায় ১০ লাখ টাকার সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করে পাউবো ২৫০ কেজি ওজনের বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ সহকারি প্রকৌশলীমোজাম্মেল হকের নের্তৃত্বে ভাঙন প্রতিরোধে বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং শুরু করেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আরফিুল ইসলাম মাখন বালুভর্তি বস্তা ফেলার কাজ করছেন।

স্থানীয়রা জানান, এ বছরের জুন মাসের শেষের দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন শুরু হয় কিশোরপুর গ্রামের তারুর বাড়ির পূর্বে থেকে গোকুলপুর খেয়া ঘাট এলাকার তোজাম্মেল মাষ্টারের বাড়ি পর্যন্ত। উপজেলার জোতকাদিরপুর-গোকুলপুরে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে অনেকের জমিজমা ও বাড়িঘরও নদীর পেটে গেছে।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন দেখা যায়, ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর আতঙ্কে পদ্মাপাড়ের মানুষের আহাজারি। শুকচাঁন আলী ও ছেতাব আলীর মতো গত কয়েক বছরের ভাঙনে জায়গা জমি হারিয়েছেন আতার পাড়ার সোবহান মোল্লা, সাধু ডাক্তারসহ শতাধিক মানুষ। হতাশ কণ্ঠে তারা বলেন, ভাঙনের আগে বালুর বস্তা (জিও ব্যাগ) ফেললে তাদের জায়গা জমি হারাতো হতো না। এখনও পদ্মাপাড়ের মানুষের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক থাকলেও তীর রক্ষায় স্থাপন করা সারি সারি বালুর বস্তায় তারা আশ্বস্ত হচ্ছেন। তবে ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবারই ভাঙনের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। কয়েক বছর ধরে পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার পাকুড়িয়া, মনিগ্রাম ও চকরাজাপুর ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী লোকজন। ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। নদী তীরবর্তী দশ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনের ফলে প্রায় সহস্রাধিক বাড়িসহ ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, বিজিবি ক্যাম্প ও কয়েক হাজার বিঘা আবাদি-অনাবাদি জমি নদীতে বিলীন গেছে। গৃহহারা হয়েছে হাজারো পরিবার। নিশ্চিহ্ন হয়েছে শত বছরের পুরনো জনপদ, বিত্তশালীরাও হয়ে পড়েন ভূমিহীন। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি অনেকে। মহদিপুর এলাকার আলিফ জানান,গত ৮ বছরে তার দাদার প্রায় ২’শ বিঘা, আতার পাড়ার সোবহান মোল্লার ৭৫ বিঘা, একই গ্রামের সাধু ডাক্তারের ১০০’শ বিঘা জমিসহ গাছপালা বিলিন হয়েছে পদ্মার ভাঙনে।

জানা যায়, ২০০০ সালে মীরগঞ্জ, আলাইপুর হয়ে গোকুলপুর, কিশোরপুর পর্যন্ত প্রায় ৭ কিঃ মিটার এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। তার পর থেকেই প্রতিবছর ভাঙতে থাকে পদ্মা। ২০০৪ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন কবলিত জায়গাগুলোতে বালির বস্তা দিয়ে তা ঠেকানোর পর ২০০৫ সালে উদয়নগর বর্ডার গার্ড (বিজিবি)ক্যাম্পসহ চৌমাদিয়া গ্রামটি রক্ষার জন্য ব্লক বসায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেই ব্লক বসানোর কয়েকদিন পর সেগুলো নদীতে ভেসে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ভাঙন ঠেকাতে বছর বছর নদীর তীর সংরক্ষনে বাঁশের বেড়া দেয়াসহ বিভিন্ন কাজ করেও নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বাধ সংলগ্ন স্থানে ড্রেজার দিয়ে দিনের পর দিন অবৈধভাবে বালু উত্তোলণের কারণে বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে। জররি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধ না করা হলে আলাইপুর গ্রামসহ আশপাশের এলাকা ও জনবসতি পদ্মাগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনে রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা)আসনের এমপি আলহাজ্ব শাহরিয়ার আলম পদ্মার তীর রক্ষায় প্রকল্পের কাজ চালু করতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ভাঙন ঠেকাতে আরও উদ্যোগী হন তিনি।

পাকুড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফকরুল হাসান বাবলু বলেন, সময় মতো সেই প্রকল্প শুরু না হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ শুধু চেয়ে দেখেছেন পদ্মার ভয়াল গ্রাসের চিত্র, দেখেছেন নিজেদের স্বপ্নের সমাধি। ‘উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দীন জানান, দ্রুত স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে উপজেলার ওইসব গ্রাম পদ্মায় নিশ্চিহ্নের আশংকা রয়েছে। জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করে অনুরোধ জানিয়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ সহকারি প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক জানান, বাঘা-চারঘাটের নদী তীরবর্তী ৪হাজার ৩’শ মিটার ব্লক বসানোর কাজের জন্য প্রস্তাবিত একটি মেগা প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের জন্য পাঠানো আছে। অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে। এছাড়াও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয় যথেষ্ট তৎপর রয়েছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com